আইডেন্টিটি পলিটিক্স

আইডেন্টিটি পলিটিক্সের বাংলা পরিভাষা কী? আমরা যখন ইলেভেন-টুয়েলভে পড়তাম, তখন বাংলায় পরিভাষা পাঠ্য ছিল। খান চল্লিশেক ইংরেজী শব্দের বাংলা মুখস্থ করতে হত – টেলিফোন মানে ‘দূরভাষ,’ মোবাইল মানে ‘চলভাষ’,- এইসব। তখনো আইডেন্টিন্টি পলিটিক্স ভালোরকম বাজারে আসেনি।

দুর্গাকে নিয়ে কোনো আলোচনা করতে গেলে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের জন্য খুব গোলমাল বাধে। একদিক সামলে কথা বলতে গেলে অন্যদিক থাকে না। যদি দুর্গাকে গ্লোরিফাই করে কথা বলতে যান, তাহলে সাবঅল্টার্নদের সাপোর্ট করা হবে না। আবার মহিষাসুরকে গ্লোরিফাই করে কথা বলতে গেলে ফেমিনিস্টদের সাপোর্ট করা হবে না। একদিকে নারীবাদ, আরেকদিকে শ্রেণীসাম্যবাদ, – কী করা উচিত বোঝা মুশকিল। যদি বলা হয় দুর্গা দেবতাদের পাঠানো যোদ্ধা ছিল, তাহলে নারীবাদী রেগে বলবে – কেন, পেছনে চাট্টি পুরুষ দেবতা না থাকলে কি দুর্গা কিছু করতে পারত না? আবার যদি বলা হয় দুর্গা সম্মুখযুদ্ধে মহিষাসুরকে হারিয়েছিল, তাহলে অন্ত্যজ গোষ্ঠীদের নিয়ে আর্টিকল-লেখা গবেষক ১ বলবে – মোটেই না, মহিষাসুরকে ব্যাকস্ট্যাব করা হয়েছিল, দুর্গার জিত আসলে সাজানো ঘটনা। আর দুর্গা আর মহিষাসুরের মধ্যে কোনোরকম যৌনতার প্রসঙ্গ ছিল, একথা বললে সবপক্ষেই প্রতিবাদ আসতে পারে – কীভাবে কথাটা পাড়া হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে কার থেকে গালাগাল খাবেন। ধর্মধ্বজীরা আপনাকে কোপাতে চাইবে কারণ আপনি দুর্গাকে বেশ্যা বলেছেন। নারীবাদীরা আরো ছোটো ছোটো গ্রুপে ভাগ হয়ে যাবে, নারীবাদী ১ বলবে দুর্গা মুক্তমনা নারীর প্রতীক, যার সঙ্গে ইচ্ছা যৌনতা করতে পারে; আবার নারীবাদী ২ বলবে দুর্গার কি আত্মসম্মান নেই, দেবতারা বলল আর সে গিয়ে মহিষাসুরের সঙ্গে শুয়ে পড়ল? আর সেক্স দিয়ে কৌশল করে জিততে হবে, এ তো দুর্বলের স্ট্র্যাটেজি; দুর্গা কি দুর্বল?? সাঁওতাল-স্পেশালিস্ট সাংবাদিক বলবে – দুর্গা চোরামি করে মহিষাসুরকে পটিয়েছিল, মহিষাসুরের মধ্যে কোনো মতলববাজি ছিল না, হি ওয়াজ টেকেন অ্যাডভান্টেজ অফ। নারীবাদী ৩ বলবে, হ্যাঁ হেরে গেলেই তখন সেই এক অজুহাত, ছলাকলা দিয়ে ভুলিয়ে মেরেছে। অন্যদিক থেকে গবেষক ২ নেমে এসে বলবে, দুর্গা আবার আর্য হল কবে, সে তো পাহাড়ী মেয়ে, মহিষাসুরের সঙ্গে যে কারণেই লেগে থাকুক তার সঙ্গে আর্যদের সম্পর্ক নেই। বুদ্ধকে যারা কেশবের অবতার বানাতে পারে, পাহাড়ী দুর্গাকে আর্য দেবী বানাতে তাদের অসুবিধা হবে এটা ভাবা বোকামো। তখন আবার কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন নিয়ে কথা শুরু হবে।

মাঝ থেকে জি আর কালার্স টিভির চ্যানেলগুলো প্রতি বছর নতুন নতুন সিরিয়াল বার করে যাচ্ছে, যেন গরীবের মার্ভেল, আরটিআই খাটছে না বলে মেকইনইন্ডিয়া প্রকল্প থেকে টাকা পায় কিনা জানা যাচ্ছে না। সেই সিরিয়ালে সিজিআই মোষ ভার্চুয়াল মরুভূমির ওপর দিয়ে দৌড়ে আসছে, স্লো মোশনে পঞ্চাশ মিটার আসতে টাইম দেড় মিনিট। ল্যাটেক্স না কীসের মুণ্ডুওয়ালা গণেশ, এক পাশে চোদুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। লড়াইয়ে কোনো রোল নেই, সিরিয়ালের নামে ‘গণেশ’ আছে বলে ওখানে ওকে রাখা হয়েছে, মাঝে মাঝে পেছন থেকে ‘তুমিই আসল, মহিষাসুর প্লাস্টিকের’ বলে মা-কে উৎসাহ দিবে।

অন্যদিকে সব স্কুলে, প্রতিটা অনুষ্ঠানে, একটি করে বাচ্চাদের দল ‘অয়ি গিরিনন্দিনী’ নাচবে। না, ভোরবেলা মহালয়ায় যেটা শোনেন সেটা নয়, রামকৃষ্ণ মিশনে যেভাবে গাওয়া হয় সেটাও নয়। একটা নির্দিষ্ট রেকর্ডিং আছে যেটা এই ব্যাপারে স্ট্যান্ডার্ড, ইউটিউবে যেখানেসেখানে পাওয়া যায়। সেটার বেশ একটা সাসপেন্সফুল রাগী-রাগী সুর, শুনে মনে হয় না যে লড়াই জেতার পর দেবীর বন্দনা করছে, মনে হয় এখন একটু পরে লড়াই লাগবে তাই তার এনভায়রনমেন্ট তৈরী করা হচ্ছে। এই ভার্শানটার সঙ্গে নাচ হবে, পুরোটা না, তিন-থেকে চারটে স্ট্যানজা শুধু, সবাই দেখে ক্ল্যাপ দেবে।

এই সার্কাসে আমার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে? – আমি চাই মাইকেল বে আর গিলেরমো ডেল টোরো মিলে একটা মহালয়া ডাইরেক্ট করুক, তাতে দুর্গা একটা তিনহাজার ফুট লম্বা রোবটে বসে কাইজু-মহিষাসুরের সঙ্গে ফাইটিং করবে। যদি কেউ এটা স্পনসর করেন, বানানো হয়ে গেলে পরে তার ভেতরকার অন্তর্নিহিত অর্থ আর বৈদিক ব্যাখ্যা আমি লিখে দোব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *