তার পর

সময় ভালো না। সময়ের নাড়ী অনেকদিনই ক্ষীণ হয়ে এসেছিল, এতদিনে আমাদের ভালোরকম নজরে পড়ছে। কে যেন বলেছিল, পাশের বাড়িতে কেউ না মরা পর্যন্ত আমাদের হুঁশ ফেরে না? – এইবারে পাশের বাড়িতে লোক মরেছে।

আমি তো নষ্ট মানুষ, আমার আর কী, দিনরাত ফুর্তিতে আছি। কিন্তু অন্য মানুষকে তো এই কালবেলায় সেই ফুর্তি দেওয়া যায় না। এরকম সময়ে ঋভুর মতো কলমের প্রয়োজন, এক নয় – একাধিক। আমি তাই ভাবলাম, বেচারি একা কত লিখবে, আমিও বরং ওর অনুকরণ করে একটা পোস্ট দিই।

মহাভারতের ক্লাইম্যাক্স। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে সমবেত দুই যুযুৎসু পক্ষ। ভায়ে-ভায়ে লড়াই। লড়াইয়ের আগে অর্জুন দেখে নিতে চেয়েছেন প্রতিপক্ষ ঠিক কারা, কৃষ্ণ রথ নিয়ে এসেছেন দুই সৈন্যদলের মাঝখানে, এবং বিপক্ষদলের যোদ্ধাদের দেখে অর্জুন ঠিক করেছেন, তিনি লড়াই করবেন না। কারণ শত্রুপক্ষে যাঁরা, তাঁরা সবাই বন্ধুজন। আত্মীয়, বান্ধব। তাঁদের রক্তে ন্যায় কিনতে অর্জুন চান না।

এর পরের ঘটনা পৃথিবীবিখ্যাত। ইতিহাসের প্রথম মোটিভেশনাল টক, সভ্যতার প্রথম সেল্প-হেল্প বুক তৈরী হল মুখে মুখে, – কৃষ্ণ তা বললেন বন্ধু অর্জুনকে, কুরুক্ষেত্রের ধর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠার সেই শুরু হল। এখন না হয় গীতা নিছক লালশালু-মোড়া বেলপাতা-পচা ঠাকুরঘর-আনুষঙ্গিকে পরিণত হয়েছে, যেমন রবীন্দ্র রচনাবলী পরিণত হয়েছে ফার্নিচারে, কিন্তু সে তো আর বইয়ের দোষ নয়।

কৃষ্ণ বলেছিলেন, অর্জুন তুমি কাকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে চাইছ? এঁরা সকলে মৃত্যুর রাজ্যে প্রবিষ্ট হয়েই আছেন, তুমি সময়ের সেই বিন্দুকে এখনো প্রত্যক্ষ করোনি – এই যা। ভবিষ্যতে কী হবে তা তোমার হাতের বাইরে, তুমি সেই নিয়ে ভাবলে কোনো কাজের কাজ হবে না। তুমি যা করতে পার তা হল এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তোমার কর্তব্য কী তা স্থির করা, এবং তার পর সেই কর্তব্য পালনে দৃঢ়ভাবে তৎপর হওয়া। – তারপরে যা হবে, হবে। মা ফলেষু।

আমাদের এখন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে আমাদের প্রজন্মের কুরুক্ষেত্র বললে অত্যুক্তি হয় না। মৃত্যু ইতিমধ্যেই দরজায় দরজায় কড়া নেড়েছে, তার ছায়া পড়েছে আরো অনেক ঘরের কাছে। বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নতুন মরণবীজ। শুধু একদিন থেকে আরেকদিনের অপেক্ষা। আমাদের অষ্টাদশ দিবস যতদিনে আসবে, ততদিনে আমাদের অনেকের অনেকটা করে খসে যাবে। এই মহামারীর সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের কেউ হয়ে পড়েছে আতঙ্কগ্রস্ত, কেউ হয়ে পড়েছে স্বার্থরক্ষায় অতিতৎপর, কেউ গায়ে মেখে নিচ্ছে সর্বংসহ উদাসীনতা। ইন্টারনেটে শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষেরা সচেতনতা বাড়াতে যথাসাধ্য লিখছেন, বলছেন; ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়াচ্ছে ফেক নিউজ, সিউডোসায়েন্টিফিক আবর্জনা; এখানে ওখানে গজিয়ে উঠছে অনিবার্য গ্যালোজ হিউমার, ফরওয়ার্ডেড হচ্ছে মেসেজে মেসেজে। পথঘাট শূন্য পড়ে আছে, যে ক’টা দোকান মুখে রুমাল চেপে দৈনন্দিন যোগান দিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সামনে জমছে অসহিষ্ণু ভিড়।

আমরা কী করব? – দিনে কতবার কাপড় কাচব? কতবার হাত ধোব দু’মিনিট বেরিয়েছিলাম বলে? কী লাভ? এ কি হিসেব রাখা সম্ভব ঠিক কোন কোন জিনিসে হাত দিয়েছি, যে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম সেই রেলিং-এ শার্টের হাতা ছুঁল কিনা, সেই শার্ট কাচার বালতিতে দেওয়ার আগে তা পাশের আলমারিতে ঘষটা খেয়ে গেল কিনা একবার, হাত ধোবার পর কল বন্ধ করার সময় সেই কলের গায়ে লাগা জীবাণু হাতে চলে এল কিনা? – এ তো পাগল হয়ে যাবে মানুষ! এ করে কি বাঁচা যায়! তার চেয়ে মনে হয় সব ছেড়ে দিয়ে যেমন চালাচ্ছি চালানোই ভালো। যদি যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ফল নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে কেনই বা অত ভাবতে যাব।

এই কেন-র উত্তর সেই কৃষ্ণের বক্তৃতায়। কেন? কেননা সেটুকু আমরা করতে পারি। সেটুকু করাটা আমাদের কর্তব্য। সেই করাটুকু আমাদের ধর্ম।

আমরা কেউই জানিনা আমাদের কার রোগ হবে। আমাদের কোন প্রিয়জনের অসুখ হবে, কে বেড পাবে অক্সিজেন পাবে, কে পাবে না। আমাদের মধ্যে কে ওই টু পার্সেন্ট, যারা মারা যাবে।  – জানিনা। যেটা জানি সেটা হল আমাদের কী করা উচিত। যা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ডাক্তাররা বলেছেন। যে চেষ্টাটুকু আমাদের পক্ষে সুস্থভাবে সহজভাবে করা সম্ভব। আমরা অর্জুন নই। কিন্তু এই ভাইরাসও কোনো মহারথী নয়। অন্য অনেক রোগের তুলনায় এই রোগ নিতান্ত অর্ধরথ। একে সম্পূর্ণ প্রতিহত করতে হয়তো আমরা পারব না, তবে একেবারে না লড়ে মরতে হবে, এমন অসহায়ও আমরা নই।

তারপর যা হবে, হবে। – মা ফলেষু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *