অডিটোরিয়ামের বাঁ পাশে হরিণদের এনক্লোজারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ময়ূরের খাঁচাটার সামনে।
এ ময়ূরগুলো ঠিক পোষ মানা নয়। বিদ্যাপীঠের পোল্ট্রিতে মুরগীকে দিয়ে তা দিইয়ে অনেকক’টা ময়ূরের ডিম ফোটানো হয়েছে, সেগুলো আজন্ম মানুষের সাহচর্যে বেড়ে ওঠা। ছোটবেলায় ধাই-মা মুরগীর পিছনে পিছনে ঘুরত, বড় হতে হতে নিজের জাত চিনে আলাদা হয়েছে। ওদেরকে খাঁচার বাইরে মাঝেমধ্যেই ছাড়া হয়, ডেয়ারীর খড়গাদা পেরিয়ে ইলেভেন-টুয়েলভের হস্টেলের কাছ অবধিও চলে আসে প্রায়ই। ওরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবে না, কোনোদিন বন্য ছিল না, হবেও না। কিন্তু এই ময়ূরগুলো, – ময়ূর ময়ূরী দুইই – এরা যারা এই হরিণদের পাশের খাঁচায় থাকে, এরা বাইরে জন্মেছে। খাঁচার বাইরে বেরোলে এদেরকে ফেরানো যাবে না। সেজন্য এরা ভেতরেই থাকে, পরিসর কম, কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
ময়ূরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পাখিগুলোকে দেখছিলাম। দুটো ময়ূর, তিনটে ময়ূরী। খাঁচার ভিতরের ঘাসছাড়া রুক্ষ মাটি, পা ফেলে ফেলে পায়চারি করছে। ময়ূরীদের তুলনায় ময়ূরের মেজাজটা বোধহয় একটু চড়া, সন্ধিৎসু চাউনিতে দেখছে মাঝে মাঝে আমার দিকে মুখ তুলে, এগিয়ে আসবে কিনা ভাবছে। গলা নামিয়ে মাটির দিকে ছোবল চালাচ্ছে, খুঁটে খাচ্ছে। আর কখনো সখনো একটা করে ডাক।
‘ক্যাঁওয়া!’
চেনা ডাক। ডাকের আগে থেকে যেটা চেনা সেটা হল ডাকের বানানটা। ‘সোনার কেল্লা’ বইয়ে ঠিক এই বানান ছিল, সার্কিট হাউসের কাছে ময়ূর ডেকেছিল। সাধারণ বাঙালীদের কাছে ময়ূর খুব একটা কাছের পাখি নয়, কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালীয়ানায় ময়ূরের অবস্থান বেশী নেই। পুজোর সময় কার্তিকের বাহন, আর বইয়ের তাকে ‘কুহু ও কেকা’। কিন্তু পুরুলিয়ার বাংলা অন্য বাংলা। মানভূমের বুনো মাঠে লম্বা পা ফেলে চরে বেড়ানো ময়ূর, এখানকার সাপ বিছে আর চোরকাঁটার সাথে বেমালুম মানিয়ে যায়।
আমি খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবছিলাম না। আমার চোখ আটকে যাচ্ছিল ময়ূরটার পায়ের দিকে। চার আঙুলে পা, তিনটে সামনের দিকে, একটা পিছনে। জোরালো, শক্তপোক্ত, মাঠচরা পাখির মার্কামারা পা। পাখির গায়ে পালক থাকে, কিন্তু এই পায়ে পালক নেই, পালক শুরু হয়েছে আরও উঁচুতে, বেশ খানিকটা ন্যাড়া পায়ের পর থেকে। আর এই ন্যাড়া পায়ে পালকের জায়গায় আছে আঁশ। স্কেলস। মাছের গায়ের ভেজা আঁশ না। শুকনো আঁশ, বর্মের মতো টুকরো টুকরো চামড়ার পাত দিয়ে তৈরী আঁশ। ড্রাই স্কেলস। যে ড্রাই স্কেলস স্কুলের বায়োলজির সিলেবাসে ছিল, আ রেগুলার ফিচার অফ আ পার্টিকুলার অর্ডার… ময়ূরটা হেঁটে হেঁটে খাঁচার ভিতরের জায়গাটায় বেড়াচ্ছিল। পাখির শরীরের একটা গতি থাকে, বিশেষ একটা ছন্দ থাকে। ময়ূরটার চলা, ওই ভঙ্গী, চোখধাঁধানো ময়ূরকণ্ঠী পালকে ঢাকা গলা বেঁকে নামছে মাটির দিকে, নামাটা ঠিক ফ্লুইড নয়, যেন আটকে আটকে, ব্রেক ডান্সের মতো থমকে থমকে নামছে, একটা জার্কিং মুভমেন্ট। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোটা… চোখ ফেরানো, চাউনি… লম্বা পায়ের ওপর বসানো ব্যালেন্স করা শরীর, সামনে লম্বাটে হয়ে বেরোনো বুক-গলা-মাথা, পিছনে লম্বা লেজ যেন তাকে কাউন্টারব্যালেন্স করছে, চলার ওই বিশেষ ঠমকটা আমার প্রচণ্ড চেনা।
ভিতরে দুটো খাটো গোলপোস্টের মতো কাঠের খোঁটার ওপর একটা লম্বা বাঁশ আড়াআড়ি বসানো, দাঁড়ের মতো করে। ময়ূরগুলোর পিঠের ওপর থেকে বুকের দুপাশে শান্তভাবে ভাঁজ হয়ে থাকা ডানা, খাঁচার ভিতরে এই ডানার উড়ালের কোনো কাজ নেই, মাটি থেকে লাফিয়ে ওই আড়াআড়ি-টানা বসার বাঁশটায় ওঠা ছাড়া। যে ময়ূরটাকে আমি দেখছিলাম, কীজন্য যেন সেটা একটু রেগে এদিকটায় তেড়ে এল। আমার চোখ সটান ওর দিকে, ইয়েলো স্পট পাগুলোর ওপর ফিক্সড। এই ধেয়ে আসা আমি জানি। এখানে না, এ জিনিস আমি দেখেছি বাড়িতে, টিভির পর্দায়। সিনেমায়। সেই সিনেমায় আমি যা দেখেছিলাম, এই চলাফেরা হুবহু তার সাথে মিলে যায়।
এ চলন শিকারীর চলন। খামারে মুরগীরা যখন কক-কক করতে করতে ধান খুঁটে খায়, কেঁচো কি কেন্নো ধরে খায়, তখন তাদের শরীরে এই একই ভাষা দেখা যায়। ময়ূর, মোরগ, – জাতভাই পাখি এরা, গ্যালিফর্মেস বর্গের সদস্য। এদের ইংরেজী নামেও তার ইঙ্গিত আছে। এরা মানুষের কাছে ঠিক শিকারী পাখি না হলেও, শিকার-শিকারীর সংজ্ঞা যে কতটা আপেক্ষিক তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। মোরগ আমাদের কাছে ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু মোরগের দু-তিনগুণ বড় চেহারার ময়ূর তেড়ে এলে মানুষ পিছপা হবে। আর যদি তার চেয়েও উঁচু, তার চেয়েও বড় হয়?
‘… উটপাখিও লম্বা হয়, তবে সেটা প্রধানত তার গলার জন্য। এ পাখির পিঠই তুলসীবাবুর মাথা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ একমাসে পাখি উচ্চতায় বেড়েছে প্রায় দেড় ফুট। গায়ের রঙও বদলেছে। বেগুনীর উপর কালোর ছোপ ধরেছে। আর জ্বলন্ত হলুদ চোখের ওই দৃষ্টি পাখির খাঁচাবন্দী অবস্থায় প্রদ্যোতবাবুর সহ্য করতে অসুবিধা হয়নি, কিন্তু এখন সে-চোখের দিকে চাওয়া যায় না….’
টেরর বার্ড। ‘ভয়াল পাখি’। আমাদের কেউ নামটা ভুলবে না চট্ করে। পুরোনো রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকা ঘেঁটে প্রদ্যোতবাবু এর পরিচয় বের করেছিলেন। শিকাগো ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে রাখা প্রতিমূর্তি ছিল এই প্রাগৈতিহাসিক পাখির, নাম ছিল অ্যাণ্ডালগ্যালর্নিস। সত্যজিৎ বাংলা করেছিলেন – বৃহচ্চঞ্চু।
আর কোস্টা রিকার পশ্চিম প্রান্তে, ববি কার্টারের কাছে হেলিকপ্টারে করে যে কন্সট্রাকশন-ওয়ার্কার লোকটাকে চিকিৎসার জন্যে আনা হয়েছিল, যাকে বাঁচানো যায়নি, তার গায়ে ববি কয়েকটা অন্যরকম আঁচড়ের দাগ পেয়েছিল। কনস্ট্রাকশন মেশিনে পড়ে জখম হলে ওরকম আঁচড় পড়ে না। এই সমস্ত ঘটনা সবার জানা। কিন্তু একটা জায়গা লোকে মনে রাখতে ভুলে যায়। পরে, ওই চ্যাপ্টারের শেষে, ঘরের ছোটো ইংলিশ ডিকশনারিটা খুলে ববি তার মধ্যে একটা শব্দের মানে খুঁজে বের করেছিল।
raptor \ n [deriv. of L. raptor plunderer, fr. Raptus]: bird of prey.
ময়ূরটার পা-ফেলার দিকে তাকিয়ে, জুরাসিক পার্কের র্যাপটরদের কথা আমার স্পষ্টভাবে মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, পঁচাত্তর মিলিয়ন বছর আগে ফেলে আসা ইতিহাস দাঁড়িয়ে চাক্ষুষ দেখছি। সামনে দেখছি পাখি, চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে আনলেই অতীত-বর্তমানের সীমানা একাকার হয়ে যাচ্ছে। বিবর্তনের ধারা অনর্গল বয়ে গেছে, যেতে যেতে সামনে-পিছনে তার মিল-বেমিলের ছাপ পরিষ্কার রেখে গেছে। ইভলিউশনের প্রমাণ হিসেবে ‘লিভিং ফসিল’ কয়েকটা প্রাণীর নাম করা হয়, যারা আজকের যুগেও ফেলে আসা দিনের চিহ্ন বয়ে বেড়ায়। কিন্তু ইভলিউশনকে সরাসরি দুচোখে দেখতে গেলে লিভিং ফসিল বা মিসিং লিংক খুঁজে বের করার কোনো দরকার নেই। আমাদের চারদিকেই, পৃথিবী-কাঁপানো ডাইনোসরদের উত্তরপুরুষরা এখনও বেঁচে আছে।
আজ অবধি যে ডাইনোসরদের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তাদের দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগটা করা হয় এদের কোমরের হাড়ের গঠনের ভিত্তিতে। একদলের কোমর আমাদের আধুনিককালের সরীসৃপদের মতো, – এদের নাম টিকটিকি-কোমর ডাইনোসর, Saurischia (গ্রীকে ‘সরাস’ মানেই টিকটিকি); আর এক দলের কোমর আধুনিক পাখিদের মতো, – এদের নাম পাখি-কোমর ডাইনোসর, Ornithischia, ‘অরনিথ-‘ মানেই যে ‘পাখি’ তা তো জানা কথা। ডাইনোসর আর পাখিদের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে তার সূত্র এই নামগুলোর মধ্যে রয়েছে। এই পাখি-কোমর ডাইনোদের থেকেই কি উঠে এল আজকের পাখি?
ভাবতে লোভ হয়, কিন্তু খোঁজ করে দেখলাম, উত্তর পেলাম: না। প্রাণের ধারা এই পথে সোজা আসেনি, ঘুরপথে এসেছে, ভুল করে উল্টো ভেবে বসছিলাম আরেকটু হলে। পাখিদের পূর্বপুরুষ অরনিথিসকিয়া ডাইনোসররা ছিল না, ছিল টিকটিকি-কোমররা। বরং স্টেগোসরাস বা ট্রাইসেরাটপসের মতো বড়, চারপেয়ে, ভারী গড়নের নিরামিষাশী ডাইনোসররা পাখি-কোমরদের মধ্যে পড়ত। দুপেয়ে দৌড়বাজ ডাইনোসরও এর মধ্যে ছিল, – হাঁসের মতো চ্যাপ্টা মুখওয়ালা হ্যাড্রোসর, ওরফে ‘ডাকবিল’। কিন্তু পাখি-কোমররা শেষ অবধি সবচেয়ে বেশীদূর এগোতে পারেনি। ডাইনোসরদের সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিবার হয়ে উঠেছিল টিকটিকির মতো কোমরওয়ালা সরিসকিয়ানরাই।
আজকের ডানাওয়ালা পাখির সংজ্ঞা যদি দিতে হয়, তাহলে কী বলব? সেলিম আলি তাঁর বইয়ে বলেছেন, ‘A bird is a feathered biped.’ পালকওয়ালা দুপেয়ে প্রাণী – সেই হল পাখি। মানুষ দু’পায়ে হাঁটে, কিন্তু তার পালক হয় না, তার গায়ে পালকের জায়গায় লোম। পালক এমন একটা বৈশিষ্ট্য যা একমাত্র পাখিদের শরীরে থাকে, আর কারও থাকে না। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি ঠিক হল না। পাখি ছাড়াও অন্য কারও কারও গায়ে পালক দেখা গেছে। তখনও পৃথিবীতে পাখিরা আসেনি। পাখিদের সুদূর পূর্বপুরুষ, বিবর্তনের নাটকে এই অঙ্কের যারা কুশীলব, তাদের প্রথম উদ্ভব – সে প্রায় আড়াইশো মিলিয়ন বছর আগেকার কথা। এত দীর্ঘ সময়ের মাপ আমাদের আন্দাজে আসে না। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল একশো চুয়ান্ন বছর আগে, দেড়শো বছরেরও বেশী। ‘সেই সময়’-এর নায়ক কালীপ্রসন্ন সিংহের জন্মসাল সঠিক জানা যায় না, তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আন্দাজ বছর কুড়ির বড় ছিলেন। এঁরা সবাই ব্রিটিশ ভারতে জন্মেছেন। ব্রিটিশ আমলের গোড়াপত্তন হয়েছিল যাদের রাজত্বের ভগ্নাবশেষের ওপর, সেই মুঘল সাম্রাজ্য ভারতে শিকড় গেড়েছিল বাবরের হাত ধরে, ১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে, এ প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার কথা। ওদিকে বাবর ভারতে আসার তিয়াত্তর বছর আগে, পাশ্চাত্য সভ্যতার বুকে সব ওলটপালট হয়ে নতুন যুগের সূচনা লেখা হয়ে যাচ্ছে, দেড় হাজার বছরের অটল রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে কনস্টানটিনোপলের পতন হল ১৪৫৩ সালে। রোমানরা একসময় গণতান্ত্রিক ছিল, রাষ্ট্রের বিপদের দিনে নেতৃত্বের প্রয়োজনে জুলিয়াস সীজারকে তারা সম্রাট হিসেবে বরণ করেছিল। সেই গদি আর সীজার ছাড়েননি, রোমান ঈগলের ছায়া দুনিয়ার ওপর ছেয়ে ছিল দেড়হাজার বছর, বেথ্লহেমের আস্তাবলে যীশুর জন্ম নেওয়ারও কয়েক বছর আগে থেকে। আর রোমানদেরও আগে ইউরোপে প্রথম আলো জ্বেলেছিল গ্রীকরা। ‘সাম্রাজ্য’ নয়, বলা হয় গ্রীক ‘সভ্যতা’। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জন্মই যে গ্রীসে! খ্রীষ্টের জন্মের চারশো-পাঁচশো বছর আগে ক্লাসিকাল গ্রীক সভ্যতার শুরু, এথেন্সের নেতৃত্বে পারস্য আক্রমণ প্রতিহত করার সেই ইতিহাস সারা পৃথিবীতে আজও গল্পে গল্পে বেঁচে আছে। ৪৯০ খ্রীষ্টপূর্বের ব্যাট্ল অফ ম্যারাথন, – যার সম্মানে আজও চার বছর অন্তর অলিম্পিক গেম্সের অলঙ্কার হিসেবে ম্যারাথন ইভেন্ট থাকে। আর তার দশ বছর পরে হয়েছিল থার্মোপাইলির যুদ্ধ। থার্মো – তপ্ত; পাইলা, বহুবচনে পাইলি – দ্বার, দরজা। The Hot Gates. স্পার্টার অধিনায়ক কিং লিওনাইডাস মাত্র একমুঠো নির্ভীক যোদ্ধা নিয়ে এক-দেড় লাখ বিদেশী শত্রুর মহড়া নিয়েছিলেন, আড়াই হাজার বছর পরেও সেই কাহিনী পপ কালচারের অঙ্গ হয়ে আছে।
আর যে যুদ্ধ, যে লড়াই মারামারি, যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ, এত উৎসাহ, এত সৃষ্টিশীলতা – তার শুরু কবে? ইতিহাসে লোহার ব্যবহার শুরু হয় ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বের আশেপাশে, তার আগে ব্রোঞ্জ যুগ আরম্ভ হয়েছিল প্রায় ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বে, তারও আগে পাথরের যুগ, নিওলিথিক পিরিয়ড। ওই সময়েই মানুষ প্রথম চাষ করতে শিখল, পশুদের পোষ মানাতে শিখল। যে ‘ক্রো-ম্যানিঅঁ’দের আমাদের পূর্বজ বলে ধরা হয়, তারা ছিল চল্লিশ হাজার বছর আগেকার মানুষ। ইতিহাসের দৃষ্টি ততদূর অতীতে পৌঁছয় না, ক্রো ম্যানিঅঁ-রা আমাদের খাতায় প্রাক্-ইতিহাস।
Cretaceous পিরিয়ডের অন্তিমপর্বে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছিল, এই ক্রীটাশিয়াস আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে শেষ হয়। পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর- মানে, এটুকু সময়ের মধ্যে ৪২২০৭৭টা রবীন্দ্র-জন্মোত্তর যুগ, ১৩০০০০টা মুঘল আমল, সাড়ে বত্রিশ হাজার রোমান সভ্যতা, ছত্রিশ হাজার ব্রোঞ্জ যুগ, আর দেড় হাজার ‘…চল্লিশ হাজার বছর আগেকার…’ ঢুকে যায়। কতদূর আন্দাজ দিতে পারলাম জানি না। ‘৪২২০৭৭’ মানে ঠিক কতটা? এক কেজি চাল কিনলে একসপ্তাহের দুপুরের ভাত হয়ে যায়। এক কেজিতে ৫০,০০০ চাল থাকে।
কিন্তু আড়াইশো মিলিয়ন বছর আগে যে থেরোপডরা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে নেমেছিল, তাদের উত্তরসূরীরা পূর্বজদের উত্তরাধিকার আজও ধরে রেখেছে। শেলীর Ozymandias বিবর্তনের এই গল্পে অবান্তর হয়ে গেছে। Theropod – মানে ‘পশু-আঙুলে’। সবচেয়ে ক্ষিপ্র, সবচেয়ে বুদ্ধিমান ডাইনোসররা সবাই এই ভাগের মধ্যে পড়ে। আর গোটা থেরোপড ভাগটা ঢোকে সরিসকিয়া ভাগের মধ্যে। থেরোপড ছাড়া অন্যধরনেরও সরিসকিয়ান ছিল, তারা প্রত্যক্ষভাবে পাখিদের পূর্বপুরুষ নয়। থেরোপডের পাশাপাশি ভাগ ছিল Sauropod, আর তার পূর্বসূরী Prosauropod। ‘প্রো-‘ বলতে ‘পূর্বকার’।
যেন রূপকথা মনে পড়ে যেতে চায়। বিরাট শরীর নিয়ে আকাশছোঁয়া উঁচু সরোপডরা দেড়শো মিলিয়ন বছর আগেকার জুরাসিক মাঠে দল বেঁধে চরে বেড়াত। পঁচাত্তর ফুট লম্বা, আটত্রিশ টন ওজনের অ্যাপাটোসরাস। ব্রন্টোসরাস, সত্তর ফুট লম্বা শরীর, ওজন পনেরো টন। সরোপডরা সবাই শাকাহারী, নিরীহ নিরামিষাশী ডাইনোসর। এদের নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। আবিষ্কারে আবিষ্কারে গবেষণা নতুন নতুন মোড় নিয়ে নেয়, ব্রন্টোসরের নাম করলাম, এই সেদিন অবধিও ব্রন্টোসরাস আর অ্যাপাটোসরাসকে অভিন্ন বলে ভাবা হত। এই দু’হাজার পনেরোয় এক গবেষণায় ঠিক হয়েছে ব্রন্টোসরাস স্বাধীন প্রজাতি, অ্যাপাটোসরাসের থেকে আলাদা জীনাস। আরও একটা বিখ্যাত নাম এই দুটোর সাথে উচ্চারিত হয়। পঞ্চাশ ফুট উঁচু, মাথা থেকে লেজের ডগা অবধি পঁচাশি ফুট লম্বা, পঞ্চান্ন টনের কাছাকাছি ওজন।
সেই সীনটা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
পান্না-সবুজ মাঠের ঢাল বেয়ে দুটো জীপ এঁকেবেঁকে এসে কয়েকটা ইউক্যালিপটাস গাছের পাশে থামল। এলি স্যাটলার – প্যালিওবটানিস্ট – একটা গাছের পাতা নিয়ে ধন্দে পড়েছেন, কারণ পাতাটা যে গাছের তা ছ’শো-সাতশো লক্ষ বছর হল পৃথিবী থেকে লোপ পেয়েছে, এ পাতা এরকম তাজা সবুজ অবস্থায় তাঁর হাতে পড়া অসম্ভব। ডঃ গ্র্যান্টকে ডেকে সেকথা বলতে চাইছেন। কিন্তু গ্র্যান্টের কান এলির দিকে নেই। গ্র্যান্টের চোখ ঘুরে গেছে অন্য দিকে, সীট থেকে তাঁর শরীরটা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, চোখ থেকে কালো চশমাটা কাঁপা হাতে খুলে এল। অসহ্য বিস্ময় আর অবিশ্বাসে গ্র্যান্টের বাকশক্তি লোপ পেয়েছে, আচ্ছন্নের মতো একটা হাত বাড়িয়ে এলির মাথাটা পাতাটার থেকে ঘুরিয়ে সটান বাঁদিকে করে দিলেন।
পরপর দাঁড়ানো ইউক্যালিপটাসগুলোর পাশ বেয়ে ধীর পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে একটা জীব। ডালপালা ছাড়িয়ে তার মুখ উঠে গেছে গাছের মাথার কাছে, লম্বা গলা বাড়িয়ে সে ইউক্যালিপটাসের মগডালে কচি কচি পাতায় কামড় বসিয়েছে।
কত লম্বা হবে ওর গলা?
জীপ থেকে নেমে এসেছেন জন হ্যামন্ড। ব্র্যাকিওসরের গলা? তিরিশ ফুট। আর চলাফেরার স্পীড বলতে, টি রেক্সটাকে ঘন্টায় বত্রিশ মাইলে ছুটতে দেখা গেছে। – টি রেক্স? … ডঃ গ্র্যান্ট টলতে টলতে ঘাসের ওপর বসে পড়েন। এলি পাশে। দু’চোখে স্বপ্ন ভরা, ওয়াকিং স্টিকের মাথায় বসানো অ্যাম্বারটা চেপে ধরে শুভ্রকেশ বৃদ্ধ এগিয়ে আসেন, একটা অপরিসীম তৃপ্তির হাসি, তাঁর অনেক, অনেক দিনের স্বপ্নকে আজ তিনি দুনিয়ার সামনে খুলে দিচ্ছেন।
” ডক্টর গ্র্যান্ট.., মাই ডীয়ার ডক্টর স্যাটলার.., – ওয়েলকাম টু জুরাসিক পার্ক। “
…..
ব্র্যাকিওসরাস। ১৯০৩ সালে মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ এলমার রিগ্স গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন উপত্যকায় এর হাড় প্রথম খুঁজে পান। কলোরাডো নদীর গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন, ‘Rocky Mountains high’-এর সেই কলোরাডো। হাড়গুলো নতুন এক সরোপডের বটে, কিন্তু সাধারণ সরোপডদের থেকে আলাদা একটা লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য দেখা গেল। সরোপডদের দেহে সামনের পায়ের চেয়ে পিছনের পা সচরাচর বেশী লম্বা হয় – আফ্রিকান হাতিদের গড়ন যেমন। এই ডাইনোসরের সামনের পায়ের দৈর্ঘ্য পিছনের তুলনায় অনেক বেশী। যেন পা-কে ছাপিয়ে ‘হাত’ই বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠতে চায় এর গঠনে। গ্রীকে brachion, মানে ‘বাহু’, আর জাতিগত উপাধি ‘সরাস’; নতুন আবিষ্কারের নাম রাখা হল ব্র্যাকিওসরাস। জিরাফের চেহারার সাথে এই চেহারার মিল আছে, ঘাড় থেকে লেজের গোড়া মাটির সাথে সমান্তরাল নয়, সামনে থেকে পিছনে ঢালু হয়ে নেমেছে। আরেকটা তফাৎও খেয়াল করার মতো। অন্যান্য সরোপডদের শরীরের তুলনায় লেজ যতটা লম্বা, ব্র্যাকিওসরের লেজ সে তুলনায় খাটো। এমনটা হওয়ার কারণ লুকিয়ে আছে ওই ব্যতিক্রমী সামনের পায়ের মধ্যে।
ইউ.এস.এ-র পোর্টল্যান্ড শহরে St. John’s Bridge নামে একটা সেতু আছে। ছবি ইন্টারনেটে সহজেই পাওয়া যায়। আমাদের হাওড়া ব্রিজ হল cantilever bridge, তার এমাথা-ওমাথা নদীর এপারে-ওপারে লাগানো, দু’ প্রান্তের মাঝে এমন কোনো স্তম্ভ বা সাপোর্ট নেই যা গঙ্গার বুকে ব্রিজের ঠেকনা হয়ে নেমেছে। সেন্ট জনস্ ব্রিজ দেখতে অনেকটা হাওড়া ব্রিজের মতোই, কিন্তু ক্যান্টিলিভার ব্রিজ নয়, সাসপেনশন ব্রিজ; দুটো টাওয়ারের দুই জোড়া থাম নদীর মধ্যে পা গেঁথে তাকে ধরে রেখেছে। দুই টাওয়ারের মাঝ দিয়ে ব্রিজের মূল রাস্তা লম্বা হয়ে বেরিয়ে গেছে। এই যে নির্মাণকৌশল, চার থামের ওপর ভর দিয়ে মূল সেতুকে ব্যালেন্স করে টাঙিয়ে দেওয়া, এটাই সাধারণ সরোপডদের শারীরিক গঠনের মূল কথা। অ্যাপাটোসরাসের চেহারা হুবহু সেন্ট জনস্ ব্রিজের মতো, সামনে বাড়িয়ে থাকা লম্বা গলা, পিছনে তাকে কাউন্টারব্যালেন্স করার জন্য দীর্ঘায়িত লেজ, – থামের মতো বিশাল চার পায়ের ভরে শূন্যে ভাসিয়ে রাখা শিরদাঁড়া ও সারা দেহ। প্রকৃতির আইনে এই চেহারা অ্যাপাটোসরাস পেয়েছে, পিছনের অত বড় ভারী লেজ না থাকলে সে হাঁটতে পারত না, এমনকী দাঁড়াতেও পারত না, সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে যেত। কিন্তু ব্র্যাকিওসরাসের শরীরের নকশা আলাদা। সামনের পা লম্বা, বুকের খাঁচা সুবিশাল ও গভীর, ভরকেন্দ্র অপেক্ষাকৃত সামনের দিকে, শরীরের ব্যালেন্স অনেকটাই ওই শক্তিশালী ‘হাত’-এর ওপর দিয়ে যায়। পিছনে ওজন বাড়ানোর জন্যে লম্বা লেজের ভূমিকা অ্যাপাটোসরাসের তুলনায় গৌণ। তাই ব্র্যাকিওসরের লেজ খাটো। খাটো মানে প্রায় মিটার সাতেক।
সরোপডরা এরকম লম্বাচওড়া, প্রোসরোপডরা এতটা নয়, তবে কাছাকাছি। এদের দুই দলকে একসাথে বলা হয় ‘Sauropodomorph’, (‘মর্ফ’ মানে শরীর) বাংলা করলে হবে ‘সরোপডসুলভ চেহারা’। সরোপডোমর্ফ আর থেরোপড, – টিকটিকি-কোমর সরিসকিয়ানদের এই দুটোই বড় ভাগ। সরোপডোমর্ফদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল লম্বা গলা আর ছোটো মাথা; অন্যদিকে ছিল থেরোপডরা।
পৃথিবীতে একটা মাত্র ডাইনোসর আছে যার সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত নাম সাধারণ মানুষের মুখে মুখে চলে, জীনাস নেম, স্পিসিস নেম – দুটোই একসাথে উচ্চারিত হয়। আজ অবধি আর কোনো ডাইনোসর বিজ্ঞানীমহলের বাইরে এতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তার নামের মধ্যেই তার একচ্ছত্রাধিপত্যের পরিচয়, সে ডাইনোসরের রাজা, ‘অত্যাচার-সম্রাট’ টাইর্যানোসরাস রেক্স। জীনাস Tyrannosaurus, অর্থাৎ অত্যাচারী টিকটিকি, স্পিসিস rex, অর্থাৎ king। স্থলচর মাংসাশী ডাইনোসরদের মধ্যে টী-রেক্স সর্ববৃহৎ নয়, জাইগ্যানোটোসরের মতো কেউ কেউ তার চেয়ে বড়। কিন্তু আকারটাই তো রাজকীয়তার শেষ কথা নয়। রেক্স ছাড়া টাইরানোসরাসের আরও অনেক প্রজাতি আছে, টাইরানোসরাস বাদেও অনেক বাঘা বাঘা জাত-শিকারী ডাইনোসর আছে। Carcharodontosaurus আছে, Velociraptor আছে। ভেলোসির্যাপটরকে আমরা একরকমভাবে চিনি, ‘জুরাসিক পার্ক’-এর র্যাপটর এরাই। এরা সবাই থেরোপড। থেরোপডদের মধ্যে থেকেই সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও আধুনিক ডাইনোসররা উঠে এসেছিল। এদের একটা শাখা এখনও পৃথিবীতে মজুত আছে। তাদের আমরা বলি ‘পাখি’।
টী-রেক্সের চালচলন দেখে সিনেমায় ডঃ গ্র্যান্ট মন্তব্য করেছিলেন – ঠিক পাখির মতো। যদি উটপাখির পায়ের দিকে তাকাই, তাহলে একথার জলজ্যান্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে। এখন আইনক্সে-আইনক্সে ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ চলছে, হল থেকে বেরোনোর পর যদি কাউকে উটপাখির পায়ের থাবার ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, বলোতো কীসের পা, সে একবাক্যে বলে ফেলতে পারে – ‘T Rex!’ কেবল একটা মস্ত ফারাকের জন্য হুবহু মিলবে না, টী-রেক্সের পায়ে তিনটে আঙুল, উটপাখির দুটো। উটপাখির আহারও অনেকটা নিরীহ, গাছ-বীজ-ফল-ফুল-দানার ওপর দিয়েই যায়, মাঝেমাঝে ফড়িং-পঙ্গপালও চলে। খাওয়ার সাথে সাথে পেটে চালান হয় কিছু নুড়ি পাথর, হজমে সাহায্য করার জন্য। এটা কয়েকজাতের প্রাণীর একটা মার্কামারা বৈশিষ্ট্য, কুমীর-অ্যালিগেটরদের মধ্যে এ জিনিস হামেশা দেখা যায়। এদের শরীরে খাদ্যনালীতে gizzard নামে একটা অংশ থাকে, তাতে গেলা খাবার মাড়াই-পেষাই হয়ে নরম সহজপাচ্য চেহারা নেয়। এই মাড়াইয়ের সময় কাজে লাগে ওই ছোট ছোট নুড়ি, গিজার্ডে থেকে ওগুলো খাবারের শক্ত টুকরোকে ভাঙতে সাহায্য করে। খাদ্যনালীতে গিজার্ড থাকা উটপাখি আর টী-রেক্সের মধ্যে আরেকটা বড় মিল; পাখি, কুমীর, ডাইনোসর, উড়ুক্কু Pterosaur – এদের সবাই গিজার্ডধারী জীব । অডিটোরিয়ামের পাশের খাঁচার এই ময়ূর, এও।
ময়ূরের চেয়েও নাটকীয়ভাবে যাদের মধ্যে র্যাপটর বেঁচে আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল আফ্রিকার সাভানা প্রান্তরের secretarybird। মাথার পাশ দিয়ে কয়েকটা কালো পালক পিছনে ঝুঁটির মতো বেরিয়ে থাকে, দেখতে লাগে কানে-কলম-গোঁজা সাবেক কালের সেক্রেটারী বা অফিস কেরানির মতো, তাই এই নাম; বাংলায় ‘কেরানিপাখি’। সেরেঙ্গেটির মাঠে যেখানে ডোরাকাটা জেব্রা আর দাড়িঝোলা বাইসন-মার্কা চেহারার উইল্ডবীস্টরা সারাদিন পালে পালে ঘুরে বেড়ায়, সেই মুলুকে এই পাখি দেখা যায়। সুন্দর চেহারা, চোখের চারপাশে উজ্জ্বল কমলা রঙ, মাথার পেছনে কালো ঝুঁটি, সাদা পালকে ঢাকা শরীর, লেজ সহ পিছনদিকটা – ‘কোট’-এর ‘টেইল’ যেখানটা হবার কথা – সেটা কালো, লম্বা পায়ের ওপরদিক কালো পালকে ঢাকা। নীচের অংশ পালকছাড়া, শক্ত আঁশে ঢাকা, আঙুলে নখ। সামনের দিকে তিনটে আঙুল, পিছনে একটা।
কেরানিপাখি পুরোদস্তুর বার্ড অফ প্রে। ঈগল চিল শকুনদের জাতভাই। ডানা মেলে আকাশে উড়তে পারে, পায়ে হেঁটেও শিকার ধরতে পারে। হেঁটে শিকার করার দিকেই ঝোঁকটা বেশী। লম্বা লম্বা পা ফেলে মাঠের ইঁদুর, খরগোশ, বেজী, টিকটিকি, ব্যাঙ, সাপ তাড়িয়ে ধরে কেরানিপাখি পেট ভরায়। এদিক থেকে বাকি শিকারী পাখিদের মধ্যে সে ব্যতিক্রম। কেরানিপাখির সবচেয়ে বেশী নামডাক সাপের যম হিসেবে। গোখরোর সাথে কেরানিপাখির লড়াই দেখলে বোঝা যায়, আদতে ব্যাপারটা কোনো লড়াইই নয়। শক্তিশালী পা দুটো এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়। সাপের গায়ের ওপর বার বার লাথি চালিয়ে আর চাপড় মেরে কেরানিপাখি তার শিরদাঁড়া ভেঙে দেয়। আহত, অচেতনপ্রায় অবস্থায় সাপের আর কিছুই করার থাকে না। অন্যান্য শিকারও এইভাবেই ধরা চলে, সেক্ষেত্রে কাজ আরও সোজা, ইঁদুরের মতো ছোটোখাটো প্রাণীরা ঠোঁটের ধারালো ঠোকরে অনায়াসেই ঘায়েল হয়। র্যাপটর শ্রেণীর পাখিদের স্বভাব পায়ের নখ দিয়ে শিকার ছিঁড়ে খাওয়া, কেরানিপাখির মধ্যেও তা দেখা গেছে। ছোটো gazelle বা হরিণছানা কেরানিপাখির শিকার হয়েছে, এমনও শোনা যায়।
সেক্রেটারীবার্ড বড় পাখি, খাড়াই চার ফুট। এমন পাখিকে শিকারী বলে মেনে নিতে অসুবিধা হয় না। ষাট মিলিয়ন বছর আগেকার অতিকায় টেরর বার্ডরাও এভাবেই শিকার ধরত। কিন্তু আমাদের বাড়ির কার্নিশে লাফিয়ে বেড়ানো ছোট্ট চড়ুই, তাকে চট্ করে ‘ঘাতক’ হিসেবে কল্পনা করতে আটকায়। চড়াই তো ধান খুঁটে খায়, কাক আর কুঁকড়োবুড়োর লড়াইয়ের ফাঁকে চুপিচুপি পায়েস খেয়ে পালায়। হ্যাঁ, পোকামাকড়ও খায় বৈকী। তাহলে সেই আরশোলা বা উচ্চিংড়েদের কাছে তার পরিচয়টা কেমন ঠেকে?
আমরা সাধারণ মানুষ, সবকিছু আমাদের একপেশে দৃষ্টি দিয়ে দেখি। যাঁরা প্রকৃতি-ঘাঁটা মানুষ, তাঁদের বয়ান পড়লে অন্য এক ছবি আমাদের চোখে ধরা পড়ে। সেই ছবি বহুমাত্রিক, আলাদা আলাদা জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলে একেকটা চরিত্রের পরিচয় পাল্টে পাল্টে যায়। কলেজে উঠে পড়েছিলাম Ted Hughes-এর কবিতা, ‘Thrushes’।
থ্রাশ চড়ুইপাখিরই একটু দূরের আত্মীয়, প্যাসেরিফর্মেস বর্গের পাখি। মিষ্টি গলার জন্য সঙবার্ড হিসেবে বিখ্যাত। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় গ্রাম ছেড়ে শহরে-আসা মেয়ে সুসান, উড স্ট্রীটের মোড়ে থ্রাশের গান শুনে পথ চলতে চলতে আনমনা হয়ে যেত। রবীন্দ্রনাথের লেখায় সেই আনমনের কথা অমর হয়ে আছে –
হায় রে রাজধানী পাষাণকায়া!
বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে
ব্যাকুল বালিকারে, নাহিকো মায়া!
কোথা সে খোলা মাঠ, উদার পথঘাট,
পাখির গান কই, বনের ছায়া!
রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ রূপান্তরে লণ্ডনের পথে থমকে দাঁড়ানো সুসান; ভোরের আলোর সাথে সাথে উড স্ট্রীটের কোণে থ্রাশের গান ফোটে, তিন বছর ধরে সেই গান তাকে শহরের বন্দীদশার মধ্যে প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের কাব্যে থ্রাশের স্থান এইখানে।
সেখানে আশৈশব পশুপ্রেমী কবি টেড হিউজ কী লিখলেন?
Thrushes
Terrifying are the attent sleek thrushes on the lawn,More coiled steel than living – a poisedDark deadly eye, those delicate legsTriggered to stirrings beyond sense – with a start, a bounce,
a stab
Overtake the instant and drag out some writhing thing.
No indolent procrastinations and no yawning states,
No sighs or head-scratchings. Nothing but bounce and stab
And a ravening second.Is it their single-mind-sized skulls, or a trained
Body, or genius, or a nestful of brats
Gives their days this bullet and automatic
Purpose? Mozart’s brain had it, and the shark’s mouth
That hungers down the blood-smell even to a leak of its own
Side and devouring of itself: efficiency which
Strikes too streamlined for any doubt to pluck at it
Or obstruction deflect.
বাউন্স অ্যাণ্ড স্ট্যাব। দক্ষ বক্সার যেমন রিংয়ের মধ্যে নিপুণ ফুটওয়ার্কে প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোণঠাসা করে, ঠিক তেমনি – তার চেয়েও বেশী ক্ষিপ্রতায়, অব্যর্থ লক্ষ্যে শিকারকে বিঁধে ফেলে ইস্পাত-নিষ্ঠুর ন্যাচারাল বর্ন কিলার। একচুল সময় নষ্ট নেই, এক ফোঁটা ইতস্তত নেই, – সজীব সচেতন মৃত্যুবাণ। মোৎজার্টস ব্রেন… শার্কস মাউথ … – যেন সতর্ক সম্ভ্রমে শার্লক হোম্স প্রফেসর মরিয়ার্টির বর্ণনা দিচ্ছেন। এই বর্ণনা নিছক আকাশকুসুম কল্পনা নয়, টেড হিউজ ছোটো থেকে জীবজন্তু-ঘেঁষা লোক, জঙ্গলের আইন তাঁর ভালোমতো জানা ছিল। তৈরী চোখ ছিল, প্রচলিত ইমেজের আড়াল থেকে থ্রাশ পাখির অন্য পরিচয়টা তিনি কবিতায় বের করে এনেছিলেন। প্রকৃতির এই ব্যবস্থায় ‘ক্রৌঞ্চ’ আর ‘নিষাদ’ অভিন্ন – ব্যাধই পাখি, পাখিই ব্যাধ।
থেরোপডদের স্বর্ণযুগ ছিল জুরাসিক আর ক্রীটাশিয়াস, জুরাসিকেই প্রথম ‘ফেদার্ড বাইপেড’ পাখিরা এসেছিল। থেরোপড ডাইনোসরদের মধ্যেও কারও কারও গায়ে পালক ছিল, যেমন র্যাপটর।
‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, তার পরে গবেষণা অনেকটা এগিয়ে গেছে। সিনেমায় র্যাপটরদের যেরকম চেহারা আছে, সেই মডেল এখন আর চলে না। সিনেমার চেহারায় র্যাপটরের গা ছিল গিরগিটি বা কোমোডো মনিটরদের মতো, খসখসে শুকনো আঁশ – ভালো বাংলায় ‘শল্ক’, মোটা চামড়া বর্মের মতো মজবুত, হিংস্র চেহারা। আধুনিক মতে কিন্তু র্যাপটরদের গায়ে পালক ছিল। এখনকার পাখিদের সাথে প্রায় কোনো তফাতই ছিল না, রীতিমতো তৈরী ডানা, লম্বা পালক-বসানো লেজ, ফাঁপা হাড়, কঙ্কালের গড়ন, – সিল্যুট ছায়া দেখলে যে কেউ পাখি বলে ভুল করবে। সাইজেও সিনেমার মতো অত বড় হত না। Velociraptor mongoliensis (মঙ্গোলিয়ায় ফসিল পাওয়া গিয়েছিল) আমাদের হাঁটুসমান উঁচু ছিল, হয়তো আরেকটু বেশী। গলা মাথা বুক পিঠ ল্যাজ পুরোপুরি পালকে ঢাকা, বিজ্ঞানীরা তো মনে করেন এদের পূর্বপুরুষরা উড়তেও পারত, পরে অভিযোজনের ফলে র্যাপটররা ওড়ার ক্ষমতা হারালেও পালক হারায়নি, যেমন পালক হারায়নি আমাদের এমু-টার্কি-উটপাখিরা। ২০০৭ সালে মঙ্গোলিয়ায় জীবাশ্মবিদরা র্যাপটরের হাতের হাড়ে স্পষ্ট quill knobs খুঁজে পান। হাত না বলে ডানা বলাই উচিত। ‘কুইল নব’ পাখিদের হাড়ে পাওয়া যায়, যেখানে যেখানে পালক মূল শরীরের সাথে যুক্ত হয়েছে, সেই সেই পয়েন্টে এটা থাকে। ভেলোসির্যাপটরের হাড়ে কুইল নব আবিষ্কার হয়ে বিজ্ঞানীদের অনেকদিনের একটা সন্দেহ ঠিক প্রমাণিত হল – র্যাপটর পালকওয়ালা ডাইনোসর। শুধু র্যাপটর কেন? টী-রেক্সও আদতে পালকওয়ালা ডাইনোসর।
টী-রেক্সের গায়ে পালক, শুনলে মনে হয় লিওনেল মেসি ব্যাট হাতে ওভালে নামছেন গোছের একটা ব্যাপার। সত্যি কিন্তু টাইরানোসরাসের গায়ে পালক হত। মাইকেল ক্রাইটন যখন স্পিলবার্গের অনুরোধ ঠেলতে না পেরে ‘জুরাসিক পার্ক’ উপন্যাসের সিকোয়েল ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ লিখেছিলেন, তখন প্রথম সিনেমার পর আরও দু’বছর কেটে গেছে। দু’নম্বর বইয়ে ক্রাইটন বাচ্চা টী-রেক্সের যে বর্ণনা রেখেছেন তাতে পালকের কথা আছে। এখন শুধু বাচ্চা নয়, পূর্ণবয়স্ক টী-রেক্সের মডেলেও পালক রাখা হয়। র্যাপটরের মতো অবিকল পাখি নয়, তবুও কম কী?
কিন্তু কথা হল, পাখির মতো পালক আছে বটে, কিন্তু সত্যিসত্যি পাখি তো এরা নয়? Avialae বলে যে ভাগের মধ্যে যাবতীয় বর্তমান ও লোপ-পাওয়া পাখিরা পড়ে, তার আওতায় তো এরা আসে না। কাজেই মানতে হয় যে পাখি ছাড়াও কারো কারো পালক থাকে, ইদানীং না থাকলেও, আগে থাকত। পাখির সাথে ডাইনোসরদের যোগ আছে, কিন্তু কোন্ পথে তা এসেছে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আরেকটা বড় জিনিস খেয়াল হল।
এই যে পাখি, এ হল স্তন্যপায়ীদের সহোদর class। Class বলতে, পুরো প্রাণীজগতকে ধাপে ধাপে বড় ভাগ থেকে ছোটো ভাগ – এইভাবে সাজানো হয়, বোঝার সুবিধার জন্য, যেমন – রাষ্ট্র, রাজ্য, জেলা, মহকুমা, থানা – এইভাবে ভূগোলে জায়গা চেনার মাপ বড় থেকে ছোট করে আনা হয়। একটা রাষ্ট্রের মধ্যে অনেকগুলো রাজ্য, প্রতিটা রাজ্যে কয়েকটা করে জেলা, একেকটা জেলায় খানকয়েক মহকুমা, – এইভাবে ধাপ নামতে থাকে। তেমনভাবে প্রাণীজগতেরও একটা সজ্জা আছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ কয়েকরকম সজ্জা নিয়ে মতের এদিক-ওদিক আছে, মোটের ওপর ধরনটা পরপর বড় থেকে ছোট সাজালে এরকম দাঁড়ায় – Kingdom > Phylum > Class > Order > Family > Genus > Species। স্কুলে থাকতে পড়া মনে রাখার জন্য এই ক্রমটার শর্টহ্যাণ্ড ছিল – Kids prefer cheese over fried green spinach! লাইকেব্ল, সন্দেহ কী। এছাড়া খুচরো কিছু কিছু subphylum (ফাইলামের চেয়ে ছোটো কিন্তু ক্লাসের চেয়ে বড়), subfamily (ফ্যামিলির চেয়ে ছোটো কিন্তু জীনাসের চেয়ে বড়) – এসব আছে, সেসব ততটা মনে রাখতে হয় না, ‘সাব-‘এর পরে কী লেজুড় আছে তাই দেখেই চেনা যায়।
যত মেরুদণ্ডী প্রাণী আছে, সবাইকে ধরে একটা সাবফাইলাম তৈরী হয়েছে – Vertebrata। নামের মধ্যে ‘ভার্টিব্রা’ দেখেই চেনা যায়। এই ভার্টিব্রাটার মধ্যে মাছ-ব্যাঙ-সাপ-টিকটিকি-কাক-চিল-বাঘ-হাতি-মানুষ সবাই পড়ে। মোট সাতটা ক্লাস – তার তিনটেয় তিনরকমের মাছ, একটায় উভচর, একটায় সরীসৃপ, একটায় পাখি, একটায় স্তন্যপায়ী।
এই যে পাখি, এ তো আমাদের মতো উষ্ণ রক্তের জীব, এর রক্ত গরম। কিন্তু সরীসৃপরা, সাপ, টিকটিকি, এরা – এদের রক্ত না ঠাণ্ডা? তাহলে?
শীতল রক্তের সরীসৃপ ডাইনোসর থেকে গরম রক্তের পাখি হল কী করে? – এর উত্তরটা এককথায় দেবার মতো নয়। প্রাণীজগতের একটা মূল জায়গায় আমরা হাত দিয়েছি।
আমরা জানি, সূর্য না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি সম্ভব হত না। আলো আর তাপ, সূর্য থেকে বিকির্ণ তেজ মূলত এই দুই চেহারায় পৃথিবীতে আসে, ইংরেজীতে বলে radiant energy। পৃথিবীর বুকে যত প্রাণী, তাদের প্রত্যেকের দেহে যে অবিরাম জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া চলছে, তার মধ্যে এই এনার্জির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পুষ্টি, প্রজনন, যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কাজ – এর গোড়ায় যে প্রক্রিয়া চলে, বিজ্ঞানের ভাষায় তার নাম বিপাক, বা metabolism। মেটাবলিজম আছে বলেই শরীর শরীরের জায়গায় থেকে তার সব কাজ চালাতে পারে। এই মেটাবলিজমের দুই ভাগ, – গড়ার যত কাজ, তাকে বলে anabolism, আর ভাঙার যত কাজ, তাকে বলে catabolism। পরীক্ষার জন্যে আমাদের শর্টহ্যান্ড ছিল: ‘আনা-‘ মানে ‘নিয়ে আসা’ বা ‘গঠন’, ‘কাটা-‘ মানে কেটেকুটে ভেঙে ফেলা। আমরা যে খাবার খেলাম, সেই খাবার আমাদের পেটে গিয়ে হজম হল, বড় বড় খাদ্যকণা ভেঙে ছোটো ছোটো কণা হল, তার দরুণ আমরা এনার্জি পেলাম – এটা হল ক্যাটাবলিজম। আর এই ছোটো ছোটো কণা আমাদের শরীরময় ছড়িয়ে গিয়ে হাড়-মাস-রক্ত তৈরী করল, গায়ে গত্তি লাগল – এই হল অ্যানাবলিজম। এই করেই দিনরাত চলেছে। এবার ঘটনা হল, কোনো মেশিন চালাতে গেলে তাকে ওয়ার্ম-আপ করাতে হয়। একটু গরম হলে তারপর গড়গড়িয়ে কাজ চলে। আমাদের শরীরেরও কাজ করার জন্য একটা নূন্যতম উষ্ণতা লাগে। সেটুকু না পেলে আমরা ঠাণ্ডায় জমে মারা যাই।
তাহলে সব প্রাণীরই শরীর গরম রাখার একটা ব্যবস্থা করতে হয়। বিভিন্ন প্রাণী এই কাজটা বিভিন্নভাবে করে থাকে। জীবজন্তুদের গা গরম রাখার যতরকম কায়দাকানুন, তার সবগুলোকে একসাথে নিলে দেখা যায় যে তাদের দুটো প্রধান ভাগে ভাগ করা যাচ্ছে।
এক হল, শরীরের বাইরের পরিবেশের ওপর নির্ভর করা। বাইরে কতটা গরম পড়েছে, কতটা রোদ, কতটা ছায়া, জলের তাপমাত্রা কত – এই সবের ওপর নির্ভর করে, তার সাথে তাল মিলিয়ে নিজের রোজকার চলন ঠিক রাখে যারা, তারা এই দলে পড়ে। এদেরকে ক্রমাগত বাইরে থেকে পাওয়া তাপের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়, শরীর যাতে অতিরিক্ত গরম বা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা না হয়ে পড়ে সেই খেয়াল রাখতে হয়। বেশী গরম হয়ে গেলেও মৃত্যু, বেশী ঠাণ্ডা হলেও তাই। এই ধরনের প্রাণীদের বলে ectothermic প্রাণী, বা এক্টোথার্ম। এদের যে শারীরিক তাপমানের ওঠানামা হওয়া, একে বলে poikilothermy, সেই সুবাদে এদেরকে পইকিলোথার্মিক জীবও বলা যায়। শামুক, কীটপতঙ্গ, মাছ, উভচর, সরীসৃপ – এরা সবাই এক্টোথার্ম। কুমীর নদীর পাড়ে শুয়ে শুয়ে রোদ পোহায়, শীতের রোদেলা সকালে প্রজাপতি গাছের পাতায় বসে ডানা মেলে তাপ নেয়। এ সবই মেটাবলিজমের জন্য শরীরকে গরম রাখার আয়োজন। কুমীর যদি রোদ পোহাতে পোহাতে ঠিক সময়ে জলে ডুব না দেয়, তাহলে তার শরীর খুব বেশী গরম হয়ে যাবে, প্রাণসংশয় দেখা দেবে। জল-ডাঙা জল-ডাঙা করে করে তাকে ব্যালেন্স রাখতে হয়। সাপ, টিকটিকি – সবাই এরা এক্টোথার্মিক, সাদা বাংলায় যাকে বলি ‘শীতল রক্তের প্রাণী’। আসলে শীতল রক্ত না, যেমন রোদ তেমন রক্ত।
দুই হল, দেহের মধ্যেকার শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই নিজের দরকারী তাপ তৈরী করে নেওয়া। বাইরে যতই ঠাণ্ডা বা গরম পড়ুক, শরীরের তাপমান অবিচল থাকবে, তার জোগান আসছে ক্যাটাবলিজমের কাটাছেঁড়ার মারফত। তথাকথিত ‘উষ্ণ রক্তের’ প্রাণীরা এই দলে পড়ে, নাম এন্ডোথার্ম। পাখি, স্তন্যপায়ী – এরা সবাই এন্ডোথার্ম। এরা যে বাইরের রোদজলের থেকে স্বতন্ত্রভাবে শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখে, এর নাম thermal homeostasis: ‘থার্ম-‘ মানে সবাই জানে, ‘হোমিও-‘ মানে ‘সম’, ‘স্ট্যাসিস’ মানে ‘স্থিতি’। ভিতরের তাপমান সব অবস্থায় সমান থাকে, তাই এই নাম। এই কায়দায় শরীরকে ঠিকমতো গরম রাখে বলে এন্ডোথার্মদের আরেক নাম হোমিওথার্ম। যদি কোনো কারণে কোনো এন্ডোথার্মের তাপমান এদিক ওদিক হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার শরীর সুস্থ নেই। 98.6 °Fছাড়ালেই মায়ের দুশ্চিন্তা, ছেলেটা আবার জ্বরেই পড়ল নাকি! এক্টোথার্মদের কিন্তু দিনের মধ্যে কয়েকবার করে তাপমান ওঠানামা হামেশাই হচ্ছে।
যেসব জানোয়ারকে খুব বেশী দৌড়ঝাঁপ করে শিকার করতে হয়, বা যাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর চাপ খুব বেশী বলে এনার্জির চাহিদা বেশী হয়, বাইরের প্রকৃতির খেয়ালের ওপর নির্ভর করলে তাদের চলে না। নিজের ক্যালোরির ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরকেই করতে হয়। কুমীর শিকার ধরার আগে ভালো করে রোদ পুইয়ে শরীরকে ঝরঝরে করে নেয়, তারপরে জলে ডুব দিয়ে ওত পাতে। অনেকক্ষণ কেটে গিয়েও যদি শিকার না পায়, তখন আবার তাকে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে রোদে বসতে হয়, এতক্ষণে শরীর আবার ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বলে। কুমীরকে যদি লাফঝাঁপ করে সারাদিন শিকার করতে হত, তাহলে এক্টোথার্ম হয়ে তার পোষাত না।
ডাইনোসররা এক্টোথার্ম ছিল না এন্ডোথার্ম, এই ডিবেট ডাইনো-বিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুকাল চলে আসছে।
ব্র্যাকিওসরাসের যেরকম আকার ও চালচলন, তাতে তার পক্ষে এক্টোথার্ম হওয়া একেবারেই অসম্ভব। সে একজন high browser, গাছপালার উঁচু ডালের পাতা খেয়ে তার আহার সমাধা হয়। প্রাগৈতিহাসিক বনেপ্রান্তরে ধীরমন্থর ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়িয়ে সে পেট ভরাত, দিনে একশোকুড়ি কেজি তার খাবার লাগত। জলাভূমিতে তার বসবাস ছিল না, আজকের দিনের জিরাফ বা হাতির মতোই সে শুকনো ডাঙার প্রাণী। একসময় ধারণা করা হত যে ব্র্যাকিওসর নির্ঘাত এক্টোথার্মিক, কারণ তার বিশাল দেহের অতিমাত্রায় গরম হয়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল, এন্ডোথার্মিক হলে তার পক্ষে সেটা সামাল দেওয়া মুশকিল। পরে দেখা গেল যে তার শরীরের এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল যাতে সে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। কীভাবে, সেটা দেখতে গেলে আরেকটা জিনিস মনে করতে হবে।
একটা সলিড শেপের জিনিসকে যদি আকারে দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ করে বাড়ানো হয়, তাহলে তার surface area আর volume, দুটোই বাড়তে থাকে। কিন্তু দুটো বাড়ার হার আলাদা। দুই সেন্টিমিটার লম্বা একটা লুডোর ছক্কা, তার একেকটা ধার 2 cm, একেক পাশের ক্ষেত্রফল 2 x 2 = 4 sq.cm, মোট ছয় পাশ মিলে 24 sq.cm। আর আয়তন 8 cubic cm। এবারে এই কিউবটাকে যদি খানিকটা বড় করে দিই, একেকটা ধার 4 cm লম্বা করে দিই, তাহলে কী হবে দেখা যাক। একেকটা ধার 4 cm, একেক পাশের ক্ষেত্রফল 4 x 4 = 16 sq.cm, মোট ছয় পাশ মিলে 96 sq.cm। আর আয়তন 64 cubic cm। কিউবটাকে বাড়িয়ে 8 cm লম্বা করলে এই হিসেবটা দাঁড়াবে ছ’পাশ মিলে 384 sq.cm, আয়তন 512 cubic cm।
একটা প্যাটার্ন এর থেকে উঠে আসছে। Surface area বাড়ার হারের চেয়ে, volume বাড়ার হার অনেক বেশী। যত বড় প্রাণী হবে, দেহের ভরের অনুপাতে তার ত্বকের ক্ষেত্রফল তত কমবে। আর আমরা জানি, তাপ বিকিরণের হার নির্ভর করে surface area-র ওপর। গরম চা পেয়ালা থেকে পিরিচে ঢেলে নিলে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়।
মানে কী দাঁড়াল? যত বিশালদেহী জীব, তার শরীর গরম থাকে তত সহজে। যত ছোটো প্রাণী, তার তাপ জুড়িয়ে যায় তত তাড়াতাড়ি। এইজন্যেই মেরু ভালুক বা সাইবেরিয়ার সাদা বাঘের শরীর তাদের জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ওতে ওদের গা গরম থাকতে সাহায্য হয়। অন্যদিকে রোগা ছিপছিপে হালকা জানোয়াররা গরম দেশে সহজে বেঁচে থাকে। যখন কোনো প্রাণী বড় দেহ হওয়া সত্ত্বেও গরম দেশের বাসিন্দা হয়, তখন তাকে শরীরে ত্বকের ক্ষেত্রফল বাড়ানোর জন্য নানারকম উপায় করতে হয়। যেমন হাতি। ভারতীয় হাতির চেয়ে আফ্রিকার হাতিদের অনেক বেশী গরমে দিন কাটাতে হয়। তাই, তাদের কান আমাদের দেশী হাতির কানের চেয়ে অনেকটাই বড়, আমাদের হাতির কান যদি কুলো হয়, ওদের কান তবে চাটাই। এই বড় পর্দার মতো কানের গায়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে শয়ে শয়ে রক্তজালিকা, শিরা-উপশিরা, তাদের মধ্যে দিয়ে অবিরাম রক্তের স্রোত শরীর ঘুরে এসে বয়ে যাচ্ছে। বয়ে যাচ্ছে, আর এতটা বেশী জায়গা পাওয়ার সুবিধায় অনেকখানি তাপ ছেড়ে দিচ্ছে বাতাসে। হাতির শরীর ঠাণ্ডা হচ্ছে।
এরকম নানাভাবে পশুপাখিরা নিজেদেরকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ব্র্যাকিওসরাসও তাই নিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ব্র্যাকিওসরের বুকের খাঁচার ভিতরে ফুসফুস ছাড়াও বাড়তি কিছু air sac ছিল, যেমন পাখিদের থাকে। এর ফলে ওদের একদিকে যেমন ওজন কমত, অন্যদিকে তেমন তাপ ছাড়ার সারফেস এরিয়ার অনেকটা সুবিধা হত। নাকের ফুটোর কাছেও এরকম ‘ছড়ানোর’ ব্যবস্থা ছিল। মোটের ওপর নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ব্র্যাকিওসরাসরা এক্টোথার্ম নয়, এন্ডোথার্মই।
র্যাপটর বা টী-রেক্সের মতো শিকারী ডাইনোসররাও এন্ডোথার্মিক ছিল, সহজেই আন্দাজ করা যায়। সারাদিন ডাকবিল তাড়িয়ে ফিরে শিকার ধরা ঠাণ্ডা রক্তের কারও কর্ম নয়। পাখিরা যে ডানা ঝাপটে আকাশে ওড়ে, তাতে প্রচুর প্রচুর শক্তি খরচ হয়, ওরাও অনিবার্যভাবে এন্ডোথার্ম। ধারণা করা হয়, থেরোপডরা সবাই মোটামুটি এন্ডোথার্মিকই ছিল। কাজেই পাখি আর ডাইনোতে এ ব্যাপারে কোনো বিভেদ নেই। ডাইনোসর বলতে সব ডাইনো নয় অবশ্য। স্টেগোসরাসদের মতো পুরোনো ডাইনোসররা ঠিক কী ছিল, সেই নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক আছে।
(চলবে)